Saturday 26 January 2013

'নাচিছে তা থৈ-থৈ ঐ মহাকাল'

আজ 26-শে জানুয়ারী 2013-র 'আনন্দবাজার' ওয়ানস্টপ ক্ল্যাসিফায়েডে 'বেড়ানো' বিভাগে প্রকাশিত আমার লেখা

'নাচিছে তা থৈ-থৈ ঐ মহাকাল'

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

                                                                          মাছ ধরছেন মেছো


গিয়েছিলাম জয়ন্তীর জলজঙ্গল ও মহাকালের পাহাড়চূড়ায়- গেল বছর হেমন্তে। ডুয়ার্সের এই এলাকা পুরোপুরি আলাদা। প্রথমদিন গাড়ি নিয়ে বনবাদাড় চষে ফেলে স্থির করলাম পরদিন যাবো মহাকাল। কিন্তু এবারেই গন্ডগোল। সবাই বলল- এক্সপিরিয়েন্স না থাকলে যাওয়া ঠিক হবেনা। কিন্তু এক্সপিরিয়েন্সটা কিসের তা বুঝতে গেলে তো যেতে হয়। পাহাড়-চূড়ায় মহাকালের অধিষ্ঠান অথচ সে রূপ স্থানীয়রা বোঝাতে পারেনা। শুধু মহাকাল শুনে নাকের পাটা ফোলানো ওদের বিস্ফারিত দৃষ্টিটুকু ছুঁতে পারি আর প্লাবনের মত তাগিদ অনুভব করি ভিতরে। সুতরাং...
                                 মহাকষ্টে মহাকালে

সুতরাং পরদিন বেরতেই হল। সকাল নটায় গাড়ি নামিয়ে দিল রুখাশুখা জয়ন্তী নদীর মাঝখানে, আমরা ছজন হাঁটতে থাকলাম। সাদা বালী-কাঁকড়ের খাত ধরে চলেছি- বাঁদিকে ছফুট উঁচুতে চর, তাতে বুকসমান সোনালী ঘাস, ডানে স্লেটরঙা পাহাড়ের কোল বেয়ে সরু বনপথ এঁকেবেঁকে গেছে ভুটানের দিকে। একদম পিকচার-পারফেক্ট ধুন-এ বাজছেন মিস্ পাহাড়ী। জুলজুল চোখে ওপথে তাকিয়ে আমরা সিধে রাস্তা নিলাম, মহাকালীন divaয় আমরা গ্রস্থ হচ্ছি ক্রমশঃ। নদীর প্রবাহ পাহাড়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সাপের মত জড়িয়ে আছে- নদী, ঝর্ণা, প্রপাত হয়ে। যত এগোচ্ছি, বদলে যাচ্ছে ছবি- নানা মাপের বোল্ডারের ফাঁক-ফোকড়ে নদী বয়ে চলেছে তিরতির। সমতলের মানুষ আমরা- বোল্ডার সামলে চলা সোজা? কোনমতে কেঁদে-ককিয়ে পেরতে-পেরতে এসে পৌঁছলাম তীব্র খরস্রোতার সামনে। দুটো পাহাড়ের ফাটল দিয়ে নদী বেরিয়ে আসছে- বাধা-বন্ধনহীন। তার গর্জন- সাদা ফেনা, তার আছাড়ি-পিছাড়ি উদ্দামতা স্তব্ধ করে দিল আমাদের। সম্বিত ফিরতে এগোলাম, পিছু চেয়ে দেখি সমতলে পড়েই নদী বদলে ফেলেছে চরিত্র। কলস্বরা তখন মিষ্টি চেহারার এক নম্রগমনা বধূ। অবাক লাগল- সামনে দেখছি ভীমাবতীকে আর পিছনেই তিনি লক্ষীস্বরুপিনী! এক অপলক অভিজ্ঞতা।
                                          বোল্ডারময় পথে

আমাদের যেতে হবে স্রোতের বিপরীত পথ ধরে ওপরে- কিন্তু ভেবে পাইনা কিভাবে। কিছুটা এগিয়ে দেখি পাহাড়ের গায় চৌদ্দ/পনেরো ফুট ওপর অবধি হেলানে রাখা এক খুঁটি, যাতে ফুটখানেক অন্তর কাটারীর চোপা। ওইটি বেয়ে উঠতে হবে। মানে? হাঁকপাঁক করে ওপরে চাই, গর্তের ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে চিলতে নীলাভ আকাশ আর আগেভাগে পৌঁছে থাকা গাইড বাপীর বাড়িয়ে রাখা হাত। ফাঁকা ঐ এরিয়াটুকুতে ওঠা দিয়েই নাকি যাত্রার সূচনা। শুরুতেই থমকে যাচ্ছি, বিস্ময়ের হাঁ বন্ধ হয়না। তবু এগোলাম- খাঁজ কাটা খুঁটিতে গোড়ালী জমিয়ে উঠতে গিয়েই বুঝলাম ওটি আলগোছেতে রাখা।
                                  যে পথে যাত্রা শুরু 

শরীরকে দুহাতের ওপর প্রায় ঝুলিয়ে-ঝুলিয়ে ওপরে পৌঁছে যেই হাঁপ ছেড়েছি, দেখি অন্যদিকের পাহাড় থেকে প্রপাতের মত জয়ন্তী তীব্র ধারাপাতে- পেরোতে হবে এবার এটা। বিস্ময়ও বিভ্রান্তিতে পড়ছে। সম্ভব? পর্বতারোহণে এসেছি নাকি? তাহলে দিদি থাকুন, বাকীদের নিয়ে আমি এগোই- নাক থেকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীমায় বলে বাপী এগোল। এতই সহজ বুঝি! উপায়ান্তর আমি ঢোঁক গিলে এগোতে থাকি। এখানের গল্প একটু অন্য। শালকাঠ নদীর এপার থেকে ওপারে ফেলে রাখা, সাপোর্ট হিসেবে কোমর-মাপে পাশে একগাছি বাঁশ। এবার কিন্তু ফেরার উপায় নেই- পিছনের জন এসে পড়েছে, আমি দাঁড়ালে সেও টলোমলো। নিজের কাছে নিজেরই যখন চ্যালেঞ্জ নেওয়া সারা তখন আত্মপ্রত্যয়ই ভরসা, এগোতে থাকলাম। ব্যস, শালকাঠে পা পড়তেই সড়াত্- বহুকাল জলে থেকে-থেকে সে শ্যাওলার্ত। ভাগ্যিস পাশে কেতরে পড়া রেলিংটুকু ছিল।
                           ভাগ্যিস পাশে বাঁশের ঠেকনা ছিল   

পুরো পথজুড়ে এমনি সাতটি সেতু পেরতে হল। ঝুরোমাটির পাহাড়ে গ্রিপ না থাকায় কম করে পাঁচবার পড়লাম আর নড়বড়ে খুঁটি পাকড়ে অন্ততঃ চারবার ওঠানামা করলাম। এইভাবে নদী পেরতে-পেরতে এসে পড়লাম চড়াই-এর সামনে। এগোব কি, শরীর সামনে ঝুঁকে থাকছে, পায়ের পাঞ্জা সিধে বসেনা কখনই। মাঝেসাঝে উত্ড়াই পড়ছে, যা আরও ভয়াবহ- ঝর্ণার জল পড়ে-পড়ে পথ পিচ্ছিল। কেউ কাঁদছে তাও এগোচ্ছে। সবটাই একসে বঢ়কর এক খতরনাক জার্নি- জীবন নিয়ে ভিডিও গেম খেলা। এভাবেই কখন যেন ধুনির সামনে উপবিষ্ট মুনির কুঠুরীর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম- ছানাবড়া চক্ষুতে। বুঝলাম, ঢুকে পড়েছি গুহায়।
                                 দু'জনে দু'জনার স্নেহে

                            আলো জ্বলজ্বলে লেপ্চা ছেলে

গুহার মধ্যে বায়ুচাপের বদলের জন্য কিনা জানিনা, মুখের মাসলে তিরতিরে কাঁপন- অনুভব এক্কেবারে নতুন ও এক্ষুনির। ভিতর ঘোরতম অন্ধকার, টিমটিমে এক প্রদীপ জ্বলছে, পাথুরে দেওয়াল বেয়ে খনিজজল চুঁইয়ে নামছে আর তারইমধ্যে চোখে ধাঁধা লাগানো টকটকে লালের আড়ম্বর। ধুনির আগুন লাল, পুরোহিত পট্টবস্ত্রে লাল, চারিদিকে সিঁদুরের ল্যাপালেপি, লাল জবার মালা, গুহায় গড়ানো জলও সিঁদুর ধুতে-ধুতে লালচে-স্রোতা। অনাস্বাদিতপূর্ব ব্দটা স্কুলে পড়েছিলাম, তার বাস্তব পরিচয় মিলল মহাকালে। ঘুরঘুট্টি কালোকে জড়িয়ে নেওয়া লালের এই আধিপত্য সম্রাজ্ঞীর মত রাজাসনে বসে আছে। টিমটিমে প্রদীপটি এমনই জায়গা বুঝে রাখা, যেখান থেকে আলো-ছায়ার মায়া মনে স্বর্গসুষমার প্রাপ্তি জোগাচ্ছে। অনবরত খনিজজল পড়ে ও জমে-জমে গুহার গায় নানান ভাস্কর্য্যের কারুকাজ (স্ট্যালাগটাইট, স্টালাগমাইট মহিমায়), পুরোহিত-বচনে তারই কোনোটা মহাকাল কোনোটা পার্বতী।
                               রুখাশুখা জয়ন্তীর বালী-কাঁকড়পথ

                                     মহাকালের পথে

গর্ভগৃহের কাছাকাছি পৌঁছেও যখন আমাদের ক্ষমতায় কুলোচ্ছিল না- তখন দেখেছিলাম মোবাইলে সব বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায়- মা, হয়তো আর ফিরব না, ভাল থেকো।ভাগ্যিস টাওয়ার ছিলনা- নাহলে কি হত বাড়ির মানুষগুলোর? ঠিক তখনই এক্সপিডিশনে আসা এক দঙ্গল ফরিস্তার সঙ্গে দেখা। তাদেরই উত্সাহে, তাদেরই শেখানো মতে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনের জোগান বাড়িয়ে শেষে পৌঁচেছিলাম চূড়ায়।
                                ডানদিকে ভুটানের শুঁড়িপথ

কষ্টের মূল্যে পাবার তৃপ্তি প্রাপ্তিঘরে চিরকালের বাসা বাঁধে। তাই ঝাঁকি দিতেই মহাকাল চেনা উত্তেজনায় এনে ফেলল তিনসেকেন্ডে। শেষের দিকে পথ ক্রমশঃ সঙ্গীন হয়েছে, তবু বাঁচতেও পারি, মরতেও পারি-র অনিশ্চয়তা দিয়েছে এক ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স।
                                 পাহাড়ি ঝোরায় ধূলোখেলা

7 comments:

Indira Mukhopadhyay said...

মঞ্জুশ্রী তোমাকে আমি চিনেছিলাম তোমার লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়ে । আবারো মন ভরে গেল । আমারো খুব ইচ্ছে র‌ইল ডুয়ার্স যাবার । আমি দার্জিলিং, গ্যাংটক-পেলিং, লাভা লোলেগাঁও আর ঋষপ গেছি কিন্তু তখন ছেলে ছোট ছিল বলে লেখা হতনা । তাই কোনো ব্লগ ও নেই । তোমার লেখার মধ্যে দিয়ে যাবার তাগিদ টা একশো গুণ বেড়ে গেল!

Aloke Bhanja said...

স্বাভাবিক-ভাবেই ভালো লাগলো তোমার লেখা ভ্রমণ কাহিনী যেমন লাগে। আমার একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে এতদিন জানতাম যারা মাছ ধরে তাদেরকে জেলে বলে - মেছো বলতে কখনো শুনিনি, আমিতো জানতাম যারা মাছ খায় তাদেরকেই মেছো বলে, বাঙালিদের সে সুনাম বা বদনামও আছে। তাহলে কি মাছ ধরলে মেছো - আর গাছ ধরলে গেছো।

Unknown said...

উফ্ পারেনও বটে। আপনি অত জাস্টিফাযেড রিজিন চাননা, অথচ... বুঝেছি, কথার মধ্যে 'পান' মেশাবার সুযোগ পেতেই এই চালাকী। হ্যাঁ, গাছ ধরলে গেছোও হতে পারে, যদি তেমন করে বোঝাতে আমি পারি। আয়া সমঝমে? মঞ্জুকে কাত্ করা অত সোজা না দাদা।

Unknown said...

কি হল আমি বুঝলাম না। ফেসবুকে তোমাকে 'আছে' জানিয়ে লাঞ্চে গেলাম, এসে দেখি তুমি আমি দু'জনেই গায়েব। তোমাকে শেষঅবধি স্প্যাম থেকে ধরে আনলেও নিজেরটা খুইয়েছি। জানিনা কি করে এসব হচ্ছে। অন্যকিছু যেমনতেমন, লেখা হারালে আমার বড্ড রাগ হয়, তা সে মন্তব্য হলেও।

Unknown said...

ইন্দিরা, এই তো তুমি আমারই মতন জায়গার কথা জায়গায় বলেছ। সবাই আজকাল সব কথা ফেসবুকে বলে। কেন রে বাবা, লেখা যেখানে পড়লাম সেখানেই তো বলব... নাকি! তুমি বেশ স্বচ্ছ্বন্দ- এমন কি অনেকেই, কেবল আমিই ফেসবুকে ক্যাবলা... কি করতে যে কি করি। তোমায় পেষে খুব ভাল লাগল কন্যে।

Unknown said...

দারুণ! ভ্রমণ তোমার নেশা, চটপট একটা বই লিখে ফেলো।

Unknown said...

বেশ কিছুদিন পর আমি মনফসলে এলাম । কয়েকটা লিখা পড়লাম, বেশ ভালো লাগলো। মনফসল নূতন উদ্যমে আপন যাত্রাপথে চলতে থাকুক । এই আশা রাখি।