Wednesday 13 March 2013

স্বপ্নসিঁড়ি

চৈতী আহমেদ


বাঁশের লাঠিটার চুড়ায় খড়ের পেচগির মাথায় গাঁথা এখনও  দুইটা গোলাপী মেঘ, মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওরা হয়ে যায় স্বপ্নসিঁড়ি! সকাল বেলা রোদ চড়তেই গোলাপী রঙের ঝালর লাগানো সাদা পোষাক গায়ে চড়িয়ে তৈরি হয়ে যাই আমি সময়ের সঙ, বুলিরও যেন তর সয় না, কারণটা সূর্যের মতই পষ্ট, এই মেঘ ফেরি করে ফিরলে তবেই হবে বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া আমাদের দুই সহোদর আর সহদোরার ক্ষুন্নিবারণ, বুলি তার ভাঁজ পড়া কপালের ভাঁজগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে পেঁজা তুলোর মতো সাদা গোলাপী মিলিয়ে বিশটার মতো হাওয়াই মিঠাইয়ের ঝাড়টা কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় পিতলের ঘন্টাটি, প্রতিদিন যেমন দেয়, এটা বুলির প্রতিদিনের স্বাভাবিক ক্রিয়া হলেও আমি প্রতিদিনিই টের পাই তার ঝাঁঝ।

যেদিন আমি সাতপুরুষের ভিটা মাটি ফেলে, চক ডাস্টারের অভ্যস্ত জীবন ভুলে যমুনার ওপার থেকে এই ঢাকা শহরের পথ চিনেছিলাম, তখন বুলি ছিলো তার স্বামীর সংসারে, নিজের পেটের সন্তান ছিলো না, সতিনের তিনটি সন্তান নিয়েই ছিলো তার দুঃখ সুখের সংসার, যেদিন শুনলো তার ভাই নুরা পাগলা মাষ্টার পয়ত্রিশ বছর আগে রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের ৭ই মার্চের ভাষন তার বজ্র কণ্ঠ নকল করে ছাত্রছাত্রীদের শুনিয়ে দিয়ে গ্রাম ছেড়েছে বুলিও সেদিন তার শেকড় বিহীন সংসার ছেড়ে এসে জুটেছিলো আমার সঙ্গে,
উনিশশো একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়দিন আগে আমার বৌটা কোথা থেকে অর্ধ উলঙ্গ ফিরে এসে বাড়ির পিছনে আম গাছে ফাঁসি নিলো, আমার নিজেকে মনে হলো অথর্ব, বৌটি আমার পোঁয়াতি ছিলো, আমি পাগল হয়ে গেলাম, ফ্রক পরা ছোট্ট ফুটফুটে একটা পরী আমার আঙ্গুল ধরে স্কুলে যেতে লাগলো, আমার নাম ছিলো নুরুল আমিন, মেট্রিক পাশ করে গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী শুরু করেছিলাম, বৌ মরার পর গ্রামের মানুষ নাম দিলো নুরা পাগলা মাষ্টার।

বুলি যেদিন ঢাকায় আসলো সেদিন রাতে আমি ভাড়ার রিক্সা জমা দিয়ে  সেগুন বাগিচার ফুটপাতের ঝুপড়িতে ফিরেছি।বুলি বিলাপ করতে লাগলো তুমি না মেট্রিক পাশ, তুমি রিক্সা চালাও? তুমি না শিক্ষক? আমি হাসলাম
–আমি পাগল ছাগল মানুষ রিক্সা কি আর চালাই, চালাইতো প্লেন, সেই প্লেনের পাইলট একটা ফ্রকপরা ছোট্ট পরি
-দেখ ভাইজান পাগল বলবা না, তুমি পাগল না, পাগলের কি আর স্বপ্ন থাকে? বুলি কথা বাড়ায় না
-আইচ্ছা ঠিক আছে, আমার ভাসুরে হাওয়াই মিঠাই বানাইয়া বেঁচে, আমি বানাইয়া দিতাম! তুমি আর রিক্সা চালাইবা না হাওয়াই মিঠাই বেঁচবা, আমি বানাইয়া দিমু তুমি বেঁচবা, হাত ধরে থাকা পরিটারও হাওয়াই মিঠাই পছন্দ হয়ে যায়, আমার সাথে রিক্সায় করে শিশুপার্কে আশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে সে হাওয়াই মিঠাই চিনে গেছে, বুলি হাওয়াই মিঠাই বানায় আমার কাঁধে উঠে বসলেই সেগুলো হয়ে যায় হাওয়ার পাঙ্খা লাগানো মেঘ, সকালেতো শিশুপারকে কোনো শিশু থাকে না, তাই সাদা গোলাপী মেঘগুলোর গন্তব্য হয় শাহবাগ হয়ে টি এস সি, 

যতক্ষণ মাথার উপর মেঘগুলো ভেসে থাকে ততক্ষণ কোনো ক্লান্তিই টের পাই না, গোলাপী মেঘ ‍দুটোর দিকে তাকিয়ে টের পাই অবষন্ন হয়ে আসছে শরীর, চারুকলার সামনে এসে শুনি –এক রাজাকারের বিচারে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে, দেখি আম গাছে আমার পোঁয়াতি বৌটা দোল খাচ্ছে, গোলাপী মেঘ দুটো গাঢ় হতে হতে দেখি রক্ত বৃষ্টি হচ্ছে ভিজে যাচ্ছি আমি, আমার ঘুম পায়, জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসে বাঁশের লাঠিটা মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, ছোট্ট পরিটা এসে ঝাকুনি দেয় বাজান বাজান উঠ যুদ্ধ ‍শুরু হয়েছে, ঐ দেখ মিছিল আমি ধড়মড় করে উঠে বসি শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে আমার চারদিক, -ফাঁসি ফাঁসি চাই, কাঁদের মোল্লার ফাঁসি চাই, একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার, আমি আম গাছের দিকে তাকাই দেখি ওখানে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা, একটা মিছিল দেখি শাহবাগের দিকে যাচ্ছে, আমি বাঁশের লাঠিটা হাতে নিয়ে মিছিল হয়ে যাই, আজ পনেরোতম দিন আছি রণাঙ্গনে।

1 comment:

Unknown said...

আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে চৈতী, এ যা লিখেছ তুমি নিজে তার পরিমাপ কি করতে পেরেছ? আমিও পারিনি... এ' লেখা পরিমাপের মাপনকাঠি কোথায়? আমি কথাহারা| শুরুতেই বাঁশের আগার বাঁধা মেঘ বিক্রির খবর দিয়ে তুমি পাঠককে জয় করছো, ধীরে টেনে আনছো তোমার ভাবনায়| তাও আবার এত কম শব্দসংখ্যার বেড়ায় বেঁধে! আমি ফ্যান হয়ে গেলাম তোমার, শিখলাম কেমন করে কাব্য থেকে গদ্য হয়ে আবার কাব্যে যেতে হয় ও শেষে রাখতে হয় চূড়ান্ত বোধীর নজির| আবার বলি... আমি মুগ্ধ চৈতী, মুগ্ধ|